ঢাকা শহরে আগুন লাগার ঘটনা বেড়ে গেলেও অগ্নি নির্বাপনে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের যান্ত্রিক সীমাবদ্ধতা এখনো পরিষ্কার। ঢাকা শহর প্রতিদিন বেড়ে চলেছে অনিয়ন্ত্রিত গতিতে। মানুষের আবাসন ও বাণিজ্যের চাহিদা পূরণে গড়ে উঠছে একের পর এক বহুতল ভবন। অথচ সেই ভবনের উচ্চতার সাথে তাল রেখে বাড়েনি ফায়ার সার্ভিস এর অগ্নি নির্বাপন সামর্থ্য। বসুন্ধরা সিটিতে অগ্নিকাণ্ডের আগে ফায়ার সার্ভিসের ১০ তলার বেশি আগুন নিভানোর কোন সরঞ্জামাদিই ছিল না। এসকল বিয়োগান্তক ঘটনা থেকে রক্ষা পেতে তাই ভবনের নকশাকালেই থাকা চাই অগ্নি নির্বাপন এবং আগুন লেগে গেলে ভবনে অবস্থানকারীদের দ্রুততার সাথে সরিয়ে নেবার ব্যবস্থা। এ বিষয়ে করণীয় তাহলে কী কী?

বহুদিন ধরেই ভবনে আগুন লেগে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনাটি ঢাকা শহরের নাগরিক জীবনের সবচেয়ে বড় আতঙ্ক। ২০১৯ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে গ্যাস সিলিন্ডার বিষ্ফোরণ ও নগর পরিকল্পনা না মেনে স্থাপন করা রাসায়নিক গুদামের কারণে চকবাজারে ঘটে যায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড যাতে মারা যান ৮১ জন মানুষ। এরপর ধারাবাহিক ভাবে ঢাকার বিভিন্ন বাজারে, মজুদ সংক্রান্ত স্থাপনায় অগ্নিকাণ্ড চলতে থাকে। এরপর মার্চ মাসে আসে এফ আর টাওয়ারের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড। এর কিছুদিন পরেই ধানমন্ডিতে একটি আবাসিক ভবনে আগুন লেগে মারা যান একজন গৃহকর্মী। 

Fire Serviceman
Fire Serviceman

ভবন নির্মাণের পূর্বেই নিশ্চিত করুন নিরাপত্তা

প্রথমেই মনে রাখতে হবে (এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ) – আপনার বাড়ির নকশা রাজউক অনুমোদিত হতে হবে। অনুমোদনে অগ্নি নিরোধক ব্যবস্থা একটা প্রধান বিষয়, তাই অগ্নি নির্বাপনে মানসম্পন্ন না হলে ভবন অনুমোদন পাওয়া উচিত হয়। বাস্তবে যদিও অনেকেই খরচ কমাতে স্থপতির সাহায্য না নিয়ে নিজেরাই হাতুড়ে লোক দিয়ে নকশা আকান এবং অবৈধ উপায়ে তা অনুমোদন নিয়ে আসেন অথবা অনুমোদিত নকশা পরিবর্তন করে ভবন তৈরি করেন। এ অবস্থায় আগুন সম্পর্কে কোন সচেতনতা নকশায় থাকে না। এটি অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।

এছাড়াও ভবনের ব্যাপারে যা যা মানতেই হবে

১। ভবনের প্রকৌশলগত অগ্নি নির্বাপন সিস্টেমকে কোনভাবেই অবহেলা করা যাবে না। সিঁড়ি কোথায় হবে বা কতটা চওড়া হবে এখানে প্রকৌশলীর কথাই শেষকথা।

২। ভবনের আকার অনুসারে সাধারণ সিঁড়ির সাথে যদি ফায়ার এক্সিটের দরকার হয় তখন তা দিতে হবে। এই ফায়ার এক্সিটকে অগ্নি নিরোধক দরজা দিয়ে বন্ধ করতে হবে এবং এটি প্রতি তলায় করতে হবে।

৩। ভবন নির্মাণের আগেই দমকল বাহিনীর অগ্নি বিষয়ক এক্সপার্ট এর সাথে কথা বলতে হবে। বাসার সামনের রাস্তায় যে উচ্চতায় আগুন নিভাতে গাড়ি প্রবেশ করতে পারে না সেই উচ্চতার ভবন নির্মাণ করা উচিত নয়।

৪। বর্তমান জীবন যাপন অনেক বেশি প্রযুক্তি নির্ভর। আমরা প্রায় প্রতিটি ঘরেই এমন প্রযুক্তি ব্যবহার করি যা থেকে আগুনের সুত্রপাত হতে পারে। তাই বৈদ্যুতিক, গ্যাস সংক্রান্ত এবং তাপ তৈরি করে এমন প্রতিটি উপকরণের সংযোগ এবং আশেপাশের সরঞ্জাম কেমন হবে এর ব্যাপারে সচেতন হতে হবে সর্বোচ্চ পরিমাণে। 

৫। ভবন থেকে ভবনের জন্য নির্ধারিত দুরত্ব রয়েছে। এটিও বজায় রাখা দরকারী যেন এক ভবন থেকে আরেক ভবনে আগুন ছড়াতে না পারে। 

Fire extinguisher
Fire extinguisher

অগ্নি নির্বাপন আইন এবং বাস্তবতা

বাংলাদেশে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুসারে ভবনে অগ্নি নির্বাপনে রয়েছে সুষ্পষ্ট বিধিমালা। সেখানে প্রতিটি অবশ্যপালনীয় ও নিরাপদ ভবনচর্চা সম্পর্কে আলাদাভাবে বলা হয়েছে। কিন্তু অগ্নি নির্বাপনের ধারণা সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয় কারণ, প্রযুক্তি জড়িত এর সাথে সরাসরি। বাংলাদেশে ২০০৬ সালে যে অগ্নি নির্বাপন আইন প্রণীত হয়েছিল এটি বারে বারে সংশোধন করার পদক্ষেপ নেয়া হলেও তা নেয়া হয়নি বিভিন্ন ধরনের চাপের কারনে। তবে বর্তমান আইনেও বসতবাড়ি, ফ্ল্যাট, মেস বোর্ডিং বা হস্টেল, আবাসিক হোটেল-মোটেল-গেস্টহাউজ বা রেস্টুরেন্ট-এ অগ্নি নির্বাপন বিধিমালা রয়েছে যা মেনে চললে ফায়ার সার্ভিস বিভাগ এর জন্য আগুন নেভানো সহজ হয়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিধিমালা নিম্নরুপ-

১. ভবনের উচ্চতা ও প্রধান সড়কের প্রশস্ততা এবং প্লটের অভ্যন্তরীণ রাস্তা সংক্রান্ত: সব প্লট ও ভবনের প্রবেশের জন্য প্রবেশ পথ থাকতে হবে এবং আবাসিক বহুতল ভবনের সামনের প্রধান সড়ক কমপক্ষে ৯ (নয়) মিটার প্রশস্ত হতে হবে। একই প্লটে একাধিক ভবন থাকলে দমকল বাহিনীর গাড়ি প্রবেশের সুবিধার জন্য মূল প্রবেশ পথে গেটের উচ্চতা কমপক্ষে  ৫(পাঁচ) মিটার হতে হবে।

২. ওয়েট রাইজার স্থাপন: ভবনে ওয়েট রাইজার থাকতে হবে। প্রতি তলার ছয়শো বর্গমিটার ফ্লোর এরিয়ার জন্য একটি ও অতিরিক্ত ফ্লোর এরিয়ার জন্য আরও একটি রাইজার পয়েন্ট থাকতে হবে।

৩. স্বয়ংক্রিয় স্প্রিংকলার স্থাপন: স্বয়ংক্রিয় ভাবে আগুনের ধোয়া বা তাপ সেন্সর করে নিজে নিজেই এক্টিভ হয়ে যায় এমন স্প্রিংকলার সিস্টেম এখন খুবই সহজলভ্য। করিডোর ও কারখানার মত জায়গায় এ ধরনের নিরাপত্তা ব্যাবস্থা বসানোকে উৎসাহিত করা হয়েছে।

৪. স্থায়ী অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থার জন্য পানি সরবরাহ: ন্যূনতম ৫০ হাজার গ্যালন ধারণক্ষমতা সম্পন্ন আন্ডারগ্রাউন্ড রিজার্ভার থাকতে হবে। রিজার্ভার থেকে পানি যাতে নেয়া যায় সেজন্য ড্রাইভওয়ে থাকতে হবে।

৫. ফায়ার ফাইটিং পাম্প হাউজ: একটি সচল পাম্প হাউজ থাকতে হবে,এটিকে নিয়মিত রক্ষনাবেক্ষণ করতে হবে এবং এটি অগ্নি নিরোধক সামগ্রী দিয়ে নির্মাণ করতে হবে।

৬. স্মোক ও হিট ডিটেক্টশন সিস্টেম: সব স্মোক ও হিট ডিটেক্টর ও এয়ার ডাম্পার এর অবস্থান নকশায় চিহ্নিত করতে হবে। এটি নিচে ফায়ার ফাইটিং রুমে মজুদ থাকবে এবং আগুন লাগলে সবচেয়ে সহজে বের করে আনার প্রক্রিয়া থাকতে হবে।

৭. ইমার্জেন্সি লাইট: জরুরি নির্গমন সিঁড়ি ও ফ্লোর প্ল্যানে এটি থাকতে হবে। এ পথ যাতে সহজে দেখা যায়। ভবনে ৫’শ জনের জন্য দুটি, এক হাজার জন পর্যন্ত তিনটি এবং এর বেশি লোক থাকলে চারটি সিঁড়ি রাখতে হবে। এটা শুধু আপৎকালীন সময়ে ব্যবহৃত হবে।

৮. বিকল্প সিঁড়ি: ছয় তলার বড় ভবনে অবশ্যই আলাদা ফায়ার এক্সিট সিড়ি থাকতে হবে এবং তা বেজমেন্ট পর্যন্ত সম্প্রসারিত হবে না।

৯. আলাদা লিফট: একাধিক লিফটের একটি বা চারটির বেশি লিফটের দুটি ফায়ার লিফট হিসেবে নির্মাণ ও নকশায় থাকতে হবে।

১০. রিফিউজ অঞ্চল:  রিফিউজ এরিয়া অর্থাৎ আগুন, তাপ ও ধোঁয়ামুক্ত নিরাপদ এলাকা। আগুন লেগে গেলে ভবন থেকে সরাসরি বের হতে না পারলে মানুষ এসব জায়গায় আশ্রয় নিতে পারে। এটিও নকশায় থাকতে হবে।

১১. রান্নাঘরের চুলার আগুন নির্বাপণের জন্য ওয়েট কেমিক্যাল সিস্টেম থাকতে হবে।

মনে রাখতে হবে, অগ্নি নির্বাপন বিধিমালা আপনার ভবনে কিছু অতিরিক্ত খরচ যোগ করতে পারে। কিন্তু সেই খরচ বাঁচাতে গিয়ে আপনি যদি বিধিমালা না মানেন বা পেশাদার স্থপতি-প্রকৌশলী দ্বারা নকশা ও স্ট্রাকচার প্রণয়ন না করেন ও অবৈধভাবে অনুমোদন নিয়ে ভবন তৈরি করেন, পরবর্তীতে আগুন এর বিপক্ষে প্রতিরোধের ব্যবস্থা না থাকায় যে ক্ষতির সম্মুখীন হবেন, তা হবে অপূরণীয়।