আমাদের দেশে নির্মাণ কাজ ইট আর বালু ছাড়া চিন্তাই করা যায় না। আপনার ইমারত তৈরিতে এগুলোকে অত্যাবশ্যকীয় ও মৌলিক উপাদান হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। তাই গুণাগুণ সম্পন্ন উপাদান ব্যবহার করা অত্যন্ত জরুরী। আবার শুধু গুণাগুণ সম্পন্ন উপাদান ব্যবহার করলেই হবে না, এর ব্যবহারবিধিও জানাটা জরুরী। বাড়ির মালিক হিসেবে আপনার প্রকৌশলগত জ্ঞান না থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সামান্য সচেতন হলে আপনি নিজেই সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। এই লক্ষ্যেই বাড়ি নির্মাণের কাজে ইট ও বালুর গুণাগুণ ও ব্যবহারবিধি উপস্থাপন করা হল।

ইট

বহু প্রাচীনকাল থেকেই নির্মাণ কাজে ইট ব্যবহার হয়ে আসছে। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে মধ্যপ্রাচ্যে আগুনে পোড়া ইট তৈরি করা হয়েছিল। মাটিকে একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় কাঁচামালে রূপান্তর করে কাঁচা ইট তৈরি করা হয়। এই কাঁচা ইট তৈরিতে আয়তঘনক আকারের ছাঁচ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। কাঁচা ইট রোদে শুকিয়ে আগুনে পোড়ানো হয় যা ঠাণ্ডা এবং আর্দ্র আবহাওয়ার বিরুদ্ধে কাজ করে ও বেশ মজবুত প্রকৃতির হয়ে থাকে।  এছাড়া ইট পাথরের মত দীর্ঘস্থায়ী এবং মজবুত না হলেও এটি সহজলভ্য এবং সাশ্রয়ী হওয়ায় নির্মাণকাজে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে।

আধুনিককালে নির্মাণকাজে বিভিন্ন ধরণের ইট ব্যবহার হয়ে থাকে। যেমন: প্রথম শ্রেণীর ইট, পিকেট ইত্যাদি। এছাড়াও সৌন্দর্য্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরণের ইট ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কিন্তু ইমারত নির্মাণে বহুলভাবে ব্যবহৃত হয় প্রথম শ্রেণীর ইট। যে কোন গাঁথুনির কাজে ব্যবহার করা হয় প্রথম শ্রেণীর ইট বিধায় এর গুণগতমানের উপর অনেকাংশে নির্ভর করে ইমারত কাঠামোর গুণগতমান।

১। ইট যেখানে তৈরি করা হয়, সে স্থানকে বলা হয় ইটের ভাটা। আমরা বাড়ি নির্মাণের জন্যে যে ইটগুলো ব্যবহার করব, সেগুলো কোন ইট ভাটায় তৈরি হয়েছে সেটা সম্পর্কেও ধারণা রাখতে হবে। কারণ, ইটের গুণাগুণ নির্দিষ্ট হয় এই ইট ভাটা থেকেই। যেমন:

ক) যে মাটি ব্যবহার করা হচ্ছে ইট তৈরির কাজে, তা কোন রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য দিয়ে তৈরি। এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। ইটের মাটির প্রধান রাসায়নিক উপাদানসমূহ হচ্ছে : সিলিকা, অ্যালুমিনা, লৌহ অক্সাইড, ম্যাগনেশিয়া, চুন ও ক্ষার। যদি এসব উপাদানের তারতম্য হয়, তবে তা ইটের গুণাগুণও ক্ষতিগ্রস্ত করে। লৌহকণা, পাথরকণা, দ্রবণীয় লবণ ও চুনাপাথর মিশ্রিত মাটি দিয়ে ভালো ইট তৈরি সম্ভব হয় না। তাই ইট কেনার আগে এলাকাভিত্তিক ইট ভাটার ধারণা নিতে হবে এটি জানার জন্য যে, কোন জায়গায় কাঁচামাল হিসেবে ভালো মাটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ভালো ইট কেনার পরও অনেক সময় লোনার সমস্যার কারণে ইমারতের স্থায়িত্ব কমে যায়।

খ) পোড়ানোর প্রক্রিয়াও গুরুত্বপূর্ণ। খুব বেশি পোড়ানো ইট যেমন ভালো না, তেমনি আধা পোড়ানো ইট দিয়েও নির্মাণকাজ ভালো হয় না। তাই সরাসরি ইটের ভাটা থেকে ইট কেনা উচিৎ। এতে ভালো ইট কেনা যায়।

২। আপনি যেখান থেকেই ইট কিনেন না কেন, প্রত্যেকটি ইটের উপরে একটি ফ্রগ মার্ক থাকবে। প্রথমত, এটি কোন কোম্পানির তা এই ফ্রগ মার্ক থেকে জানা যায়। এছাড়া গাঁথুনির সময়ে এটি পার্শ্বীয় শক্তি বাড়াতে সাহায্য করে।

৩। প্রত্যেকটি প্রথম শ্রেণীর ইট অবশ্যই একই মাপ একই রঙ এর হতে হবে। বাংলাদেশে একটি প্রথম শ্রেণীর ইটের আকার ৯-১/২”X৪-১/২”X২-৩/৪” (২৪০ মিঃমিঃX ১১৫ মিঃমিঃX৭০ মিঃমিঃ)। এছাড়া ইটের গায়ে কোন ধরণের ফাটল বা বায়ুর বুদবুদের চিহ্ন থাকা যাবে না।

Brick Size
Brick Size
Brick Shape
Brick Shape

৪। খুব সহজে কিছু পরীক্ষা দ্বারা ইটের গুণাগুণ চিহ্নিত করা যায়। যেমন:

ক) দুইটি ইট দ্বারা ইংরেজি অক্ষর “T” এর মত তৈরী করে যদি ৪ ফুট উঁচু স্থান হতে শক্ত ও সমতল ভূমিতে ছেড়ে দেয়ার পর উপরের ইটটি যদি ভেঙ্গে যায়, তাহলে বুঝতে হবে ইট ভালো নয়। খেয়াল রাখতে হবে পরীক্ষাটি করার সময় ইট দু’টো এমনভাবে সংস্থাপন করতে হবে যেন উভয় ইটের ফ্রগ মার্ক সামনে থেকে দৃশ্যমান হয়।

brick test
brick test

খ) ধাতব পদার্থের আঘাত যেমন শোনায়, একটি ইটকে অন্য ইট দিয়ে আঘাত করলে যদি তেমন আওয়াজ হয়, তাহলে বুঝতে হবে ইটের মান ভালো।

গ) একটি ইটের গায়ে যদি পেরেক বা আঙুল দ্বারা দাগ দেয়া যায়, তাহলে বুঝতে হবে ইটের গুণগত মান খারাপ। যদি কোনো প্রকার দাগ না বসে, তাহলে বুঝতে হবে সেটি ভালো ইট।

৫। সাইটেই একটি ইটকে ভেঙ্গে পরীক্ষা করা যেতে পারে। যদি গঠনরীতি সরূপ হয় অর্থাৎ পোড়ানো সর্বত্র সমান এবং যতটা সম্ভব কম ও সমানভাবে ফাঁকা থাকে, তবে তাকে ভালো ইট বলা যাবে।

৬। একটি ভালো ইটের ওজন ৬ পাউন্ড বা ২.৭২ কেজি।

৭। উন্নত মানের ইট পানিতে ডোবালে সর্বোচ্চ ১৫% এর বেশি পানি শোষণ করতে পারে না। তাই সাইটে ইট পানিতে চুবিয়ে রেখে ওজন পরীক্ষা করে ভালো ইট সনাক্ত করা যেতে পারে।

৮। ব্যবহারবিধি:

ক) গাঁথুনির আগে ইট ভেজাতে হবে। ইটের পানি শোষণ ক্ষমতা বেশি হওয়ায় না ভেজালে মশলার পানি শোষণ করে ফেলবে যা গাঁথুনির স্থায়িত্ব কমিয়ে দিবে।

খ) যে স্থানে গাঁথুনি করা হবে, সে স্থান অবশ্যই পরিষ্কার ও চিপিং করে নিতে হবে।

গ) গাঁথুনির লে আউট ও উলম্ব লাইন ঠিক আছে কিনা বারবার দেখে নিতে হবে।

ঘ) গাঁথুনির মাঝে ভালোভাবে মশলা ঢুকেছে কিনা দেখতে হবে। একটি ইটের উপর আরেকটি ইটের সংযোগস্থল যেন ১০ মিঃমিঃ এর বেশি না হয়।

ঙ) যেদিন গাঁথুনি করা হচ্ছে সেদিনের তারিখ স্থাপনার দেয়ালের গায়ে লিখে দিলে ভালো। কারণ ৭ কিউরিং করার সময় সহজে বোঝা যায় কতদিন পানি দেওয়া হয়েছে।

brick wall
brick wall

বালি

নির্মাণ কাজের জন্যে বলতে গেলে বালি ছাড়া কোন কাজ করাই সম্ভব নয়। ঢালাই, ইটের গাঁথুনি, প্লাস্টার ইত্যাদি কাজে বহুলভাবে এটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এটি মূলত সিলিকা থেকে পাওয়া যায়। সাধারণত সমুদ্র বা নদীর উপকূলে, সমুদ্রের তলায়, নদীয় তলায় বালি পাওয়া যায়। এই বালিকে আমরা তিনভাগে ভাগ করতে পারি। এগুলো হচ্ছে: পিট বালি, নদীর বালি, সমুদ্রের বালি। পিট বালি সাধারণত ভরাট করার কাজে ব্যবহৃত হয়। সমুদ্রের বালিতে ক্ষতিকর লবণ থাকায় ব্যবহারের অযোগ্য। তাই নির্মাণকাজে মূলত নদীর বালি ব্যবহার করা উচিৎ। এখানে আমরা প্লাস্টার বা গাঁথুনির জন্য ব্যবহৃত চিকন বালি নিয়ে আলোচনা করব।

১। নির্মাণ কাজে বালি ব্যবহার করার আগে কোন প্রকার ময়লা, কাদামাটি যেন না থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে। নির্মাণ কাজের পূর্বে বালি ভালভাবে ধুয়ে নিতে হবে যেন বালির সাথে সংযুক্ত কাদা, ময়লা, আগাছা, ডালপালা, নুড়ি বের হয়ে যায়।

২। খুব সহজে কিছু ক্ষেত্রে পরীক্ষা দ্বারা ইটের গুণাগুণ চিহ্নিত করা যেতে পারে। যেমন:

ক) এক হাতের তালুতে বালি নিয়ে অন্য হাত দিয়ে ঘষলে যদি হাতের তালুতে ময়লা লেগে যায়, তবে বুঝতে হবে বালি ভালো নয়।

খ) সামান্য বালি মুখে নিয়ে লবণাক্ততা পরীক্ষা করা যেতে পারে।

৩। একটি কাচের গ্লাসে ১/৪ ভাগ বালি দ্বারা এবং ৩/৪ ভাগ পানি দ্বারা পূর্ণ করে ঝাঁকানোর পর স্থির করলে যদি বালির স্তর একেবারে নিচে থাকে, তবে বুঝতে হবে বালি ভালো। রঙহীন হলেও ভালো বালি বলে চিহ্নিত হবে।

sand test
sand test

৪। ৩% কস্টিক সোডা সল্যুশনের সাথে অল্প কিছু বালি যোগ করে একটি বোতলে কিছুক্ষণ ঝাঁকিয়ে ২৪ ঘন্টা ঐ অবস্থায় রেখে দিতে হবে। যদি বোতলে রক্ষিত দ্রব্যের রং পরিবর্তন হয়ে বাদামী হয়, তবে বুঝতে হবে বালিতে রাসায়নিক পদার্থ বিদ্যমান।

৫। আমরা সাইটে বালি ট্রাকে করে নিয়ে আসি। অনেক সময় অল্প শিক্ষিত মানুষ এই বালি গ্রহণ করে থাকে। সেই ব্যক্তিকে বোঝাতে হবে যে এক ট্রাক শুকনো বালির চেয়ে এক ট্রাক ভেজা বালির ওজন অনেক বেশি। তাই রাতের বেলা বালি সাইটে আসলে অবশ্যই তা শুকনো/ভেজা তা দেখে নিতে হবে। কারণ সম্পূর্ণ শুকনো বালিতে পানি মেশালে বালির আয়তন বৃদ্ধি পায়। এই বৃদ্ধির ফলে আমরা পরিমাণে কম বালি পাব।

৬। সাইটে পানি দিয়ে পরিশোধনের পর আগে শুকাতে হবে। ভিজা বালি নির্মাণ কাজে ব্যবহার করলে তা স্থায়িত্ব কমিয়ে দেয়।

৭। ল্যাবরেটরিতে বালির দানার গ্রেডিং নিরূপণ করা হয়। এই পরীক্ষার ফলাফলকে Fineness Modulus (FM) দ্বারা প্রকাশ করা হয়। নির্মাণ কাজের জন্য উপযুক্ত চিকন বালির এফ এম ১.২ থেকে ১.৫ হতে হবে।