ভূমিকম্প আজকের সময়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্করগুলোর একটি। যেকোনো মুহূর্তে বহু মানুষের প্রাণক্ষয়সহ অনেক ক্ষতিসাধন করতে সক্ষম এই দুর্যোগ। সেকারণে স্থায়ীভাবে সাবধানতা অবলম্বনও জরুরি।

ভূ-অভ্যন্তরে যখন একটি শিলা অন্য একটি শিলার উপরে উঠে আসে তখন ভূমির কম্পন হয়। মূলত ভূমিকম্প বলতে পৃথিবী পৃষ্ঠের অংশ বিশেষের হঠাৎ অবস্থান পরিবর্তন বা আন্দোলনকে বুঝায়। 

তীব্রতা অনুসারে ভূমিকম্প তিন প্রকার- প্রচণ্ড, মাঝারি এবং মৃদু। আবার ভূপৃষ্ঠ থেকে ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থলের দূরত্বের উপর নির্ভর করে তিন ভাগে বিভক্ত-

– অগভীর (দূরত্ব ৭০ কিলোমিটারের মধ্যে হলে)

– মধ্যবর্তী (দূরত্ব ৭০ থেকে ৩০০ কিলোমিটারের মধ্যে হলে)

– গভীর (দূরত্ব ৩০০ কিলোমিটারের বেশি হলে)

ভূমিকম্পের কারণ

– ভূ-পৃষ্ঠের হঠাৎ পরিবর্তন 

– আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত

– শিলাচ্যুতি

ভবনকে ভূমিকম্প থেকে সুরক্ষার উপায়

বাংলাদেশ ভূমিকম্প-প্রবণ এলাকা। বাংলাদেশে ৮টি ভূতাত্ত্বিক চ্যুতি এলাকা বা ফল্ট জোন সচল অবস্থায় রয়েছে। আমাদের দেশে অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে ভূমিকম্পে ঝুঁকির মাত্রা আরও বেশি। রাজউকের তথ্যমতে, পরিকল্পনা অনুযায়ী শহরের মাত্র ১০ শতাংশ এলাকা নির্মিত হয়েছে, বাকি ৯০ শতাংশই অপরিকল্পিত। ঘনবসতি, অতিরিক্ত জনসংখ্যার কারণে ঢাকা সহ দেশের বড় বড় বিভাগীয় শহরগুলো রয়েছে ভূমিকম্প ঝুঁকিতে। সেজন্য ভবন নির্মাণের পূর্বে জেনে নেয়া প্রয়োজন ভবন নির্মাণে ভূমিকম্প থেকে সুরক্ষার খুঁটিনাটি।

জাতীয় বিল্ডিং কোডের নীতিমালা মেনে চলা

ভূমিকম্প প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়, শুধু সচেতনতার মাধ্যমেই ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতি কিছুটা লাঘব করা সম্ভব। ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে ভূমিকম্প প্রতিরোধক নকশা ব্যবহারের মাধ্যমে ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি অনেকটা এড়ানো সম্ভব।

ভবনের কাঠামো লোডের অনুপাত অনুসারে হওয়া 

ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে বহুতল ভবনের নীতিমালা মেনে চলতে হবে। ছয় তলার অধিক ভার বহনকারী ভবন নির্মাণে অবশ্যই রিইনফোর্সমেন্ট ব্যবহার করতে হবে। উচ্চতা ও লোডের হিসাব অনুসারে ভবনের ভিত্তি দিতে হবে। নরম মাটিতে ভবন নির্মাণ না করাই শ্রেয়। যদি একান্তই করতে হয় তাহলে লক্ষ্য রাখতে হবে ভিত্তি যেন শক্ত মাটি পর্যন্ত হয়।

ভূমিকম্প প্রবন এলাকা

পাহাড়ি এলাকায় ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে আগেই মাটির বোরিং টেস্ট করে নিতে হবে। ভবনের পাশে পাহাড় বা পানি থাকলে মাটির সমান্তরাল লোড বিবেচনায় নেয়া আবশ্যক।

নির্মাণ সামগ্রীর ক্ষেত্রে হালকা ম্যাটারিয়ালের ব্যবহার

এমএস রড ব্যবহারে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। শুধু দরজা-জানালার ওপর দিয়ে দেয়ালের চারপাশে লিন্টেল দেয়াই শ্রেয়। ভবনের নকশা, কলাম ও বীম ডিজাইনের সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যেন ভবনটি সিসমিক লোড ও উইন্ড লোডের জন্য সহনীয় হয়। কনক্রিট প্রস্তুত করার সময় খোয়া, সিমেন্ট, বালির উপযুক্ত অনুপাত বজায় রাখতে হবে।

ভবনের দূরত্ব সংক্রান্ত নীতিমালা

জনবহুল এলাকায় এক ভবন থেকে অন্য ভবনের দূরত্ব কমপক্ষে ছয় ফুট থাকবে। একান্তই সম্ভব না হলে দুই ভবনের মাঝখানের মাটিকে কংক্রিট সামগ্রী দিয়ে শক্ত করতে হবে।

ভবনের সামনে জায়গা

ভবন নির্মাণের সময় ভবনের সামনে রাজউকের নীতিমালা অনুসারে ফাঁকা জায়গা রাখতে হবে যেন যেকোনো প্রয়োজনে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি নির্দ্বিধায় প্রবেশ করতে পারে। 

গ্যাস এবং বৈদ্যুতিক লাইনের নিরাপদ স্থাপন

ভূমিকম্পের সময় অনেক ক্ষেত্রে ত্রুটিপূর্ণ বিদ্যুৎ এবং গ্যাস লাইনের কারণে আগুন ধরে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা আরও বেশি হতে পারে। তাই বিল্ডিং নির্মাণের সময়ই এই বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে।

ভূমিকম্প ওয়েভ

গৃহসজ্জায় সতর্কতা

ঘরের অভ্যন্তরে উঁচু ফার্নিচার যতটা সম্ভব দেয়ালসেটিং করতে হবে, কাচের সামগ্রী, প্লেট গ্লাস বদ্ধ শোকেস বা ক্যাবিনেটে রাখতে হবে। তুলনামূলক ভারী জিনিসপত্র আলমারী বা ক্যাবিনেটের নিচের দিকে রাখতে হবে। দেয়ালে ঝোলানো ভারী শোপিস যেমন ছবির ফ্রেম, আয়না ইত্যাদি বিছানা, সোফা অথবা অন্য কোনো বসার স্থান থেকে দূরে রাখতে হবে যেন ভূমিকম্পের সময় এগুলো থেকে আহত হবার ঝুঁকি কম থাকে।

বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম সক্রিয় ভূকম্পন বলয়ে অবস্থিত। অথচ ভূমিকম্প মোকাবেলায় বাংলাদেশের প্রস্তুতি খুবই অপ্রতুল। সুতরাং মাঝারি কিংবা বড় মাত্রার ভূমিকম্পের ব্যাপক ধ্বংস লাঘবে ও ভবনের ভূকম্পন সহনশীলতা বাড়াতে বিল্ডিং কোড মেনে চলা জরুরি, বিশেষ করে ঢাকা, সিলেট ও চট্টগ্রামের মতো ভূমিকম্পপ্রবণ শহরগুলোতে।