‘সয়েল টেস্ট’ কথাটির আভিধানিক অর্থ হলো ‘মাটি পরীক্ষা’। নিজের জমিতে যেকোনো ধরনের স্থাপনার কাজে যখন যাবেন, একজন প্রশিক্ষিত স্থপতি এবং প্রকৌশলী আপনার কাছে প্রথমেই দুটি জিনিস চাইবেন। এর একটি হচ্ছে জমির ডিজিটাল সার্ভে। আর দ্বিতীয়টি হলো এই ‘সয়েল টেস্ট’।

সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পরিভাষায় একে কখনো বলা হয় সয়েল টেস্ট, আবার কখনো বলা হয় সাব সয়েল ইনভেস্টিগেশন। যেকোনো ধরনের স্থাপনার কাজের আগে জমির সয়েল টেস্ট বা মাটি পরীক্ষা করে নেওয়া বাধ্যতামূলক। শুধুমাত্র ভবন তৈরিই নয়, ব্রিজ বা কালভার্ট, হাইওয়ে বা দুই লেন বা তার চেয়ে বেশি চওড়া পাকা রাস্তা, রেলপথসহ সব ধরনের কাঠামোগত উন্নয়নের ক্ষেত্রেও মাটি পরীক্ষা অপরিহার্য। যেকোনো স্থপতিই আপনাকে জানাবেন যে নকশার কাজে হাত দেবার আগে অবশ্যই সয়েল টেস্ট করাতে হবে। কিন্তু কেন এই পরীক্ষণ এতটা গুরুত্বপূর্ণ?

  • প্রথমত, মাটির বিয়ারিং ক্যাপাসিটি বা ভার বহনের ক্ষমতা নকশার আগেই বুঝে নিতে হয়। সয়েল টেস্ট এর মাধ্যমেই এই ক্ষমতা সম্পর্কে সূক্ষাতিসূক্ষ ধারণা পাওয়া সম্ভব।
  • দ্বিতীয়ত, ভবনে ঠিক কী ধরনের ফাউন্ডেশন ব্যবহার করা হবে সে ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত নেয়া যায় জমির মাটি পরীক্ষার ফলাফল থেকেই। মাটির ক্ষমতা বেশি হলে অনেক ক্ষেত্রে অগভীর ফাউন্ডেশন ব্যবহার করা হয়। যদি ক্ষমতা কম হয় সেক্ষেত্রে পাইলিংয়ের মতো গভীর ফাউন্ডেশন ব্যবহার করা হতে পারে।
Soil sample collection for test
Soil sample collection for test

বিয়ারিং ক্যাপাসিটি এবং ফাউন্ডেশন টাইপ দুটিই ফলাফলে উল্লেখ করা থাকে। এর সাথে SPT, মাটির ধরন, মাটির বিভিন্ন স্তরের বিবরণ, মাটিতে উপাদানের উপস্থিতিসহ বোরিং পয়েন্ট লে-আউটও উল্লেখ থাকে এই ফলাফলে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, এই পরীক্ষণ না করলে ফাউন্ডেশনের নকশা করা প্রায় সম্ভব। সঠিক ফাউন্ডেশনের অভাবে ভবনের নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে:

  • স্থাপনা মাটিতে দেবে যাবার সম্ভাবনা।
  • ফাউন্ডেশন দেবে বা বেঁকে যাওয়ার ফলে বা অতিরিক্ত চাপের কারণে ফাটল তৈরি হতে পারে।
  • ভূমিকম্পের প্রভাবে মাটি সরে যাওয়া সম্পর্কে ধারণা বা জ্ঞানের অভাব রয়ে যেতে পারে।
  • বন্যার সম্ভাবনা ও মাটিতে আর্সেনিকের উপস্থিতি সম্পর্কেও জানা না থাকতে পারে।

বাংলাদেশে সাধারণভাবে মাটির ভার বহন ক্ষমতা প্রতি বর্গমিটারে ৯-১০ টন হয়ে থাকে। অনেকে ছোট ভবনের ক্ষেত্রে মাটি পরীক্ষা না করেই ভবন তৈরি করতে চাইতে পারেন, কারণ, ভবনের ভার এর চেয়ে বেশি হওয়া প্রায় অসম্ভব। তবে ভবিষ্যৎ নির্মাণের সম্ভাবনা ও নিরাপত্তার স্বার্থে অবশ্যই এই পরীক্ষণ করানো উচিত। একটি সয়েল টেস্টিং সেটে এই পরীক্ষাগুলি সাধারণত পাওয়া যায়:

  • সয়েল ক্লাসিফিকেশন
  • পার্টিকেল সাইজ ডিস্ট্রিবিউশন
  • ময়েশ্চার কন্টেন্ট ডিটারমিনেশন
  • স্পেসিফিক গ্র্যাভিটি
  • লিকুইড লিমিট আর প্লাস্টিক লিমিট টেস্ট
  • ময়েশ্চার কন্টেন্ট
  • পার্টিকেল সাইজ আর স্পেসিফিক গ্র্যাভিটি টেস্ট

সাধারণত সয়েল টেস্টিং এর জন্য আলাদা কোম্পানি থাকে। অনেক ক্ষেত্রে জমির সার্ভে কোম্পানি লাইসেন্স থাকা সাপেক্ষে এটি করতে পারে। আপনি আপনার জমির নকশায় নিযুক্ত স্থপতি ও প্রকৌশলীর কাছ থেকে এরকম দক্ষ কোম্পানির সন্ধান পেতে পারেন। বাংলাদেশে জমির মাটি পরীক্ষায় সবচেয়ে বেশি যে পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় তার নাম ‘ওয়াশ বোরিং’ পদ্ধতি। এখানে যা যা করা হয় তা অনেকটা এরকম:

  • পানির সাহায্যে দুই ইঞ্চি ব্যাসের একটি নলকে চাপ প্রয়োগ করে মাটিতে প্রবেশ করানো হয়।
  • প্রতি পাঁচ ফুট বা দেড় মিটার পর পর ঘাত সংখ্যা ও মাটির নমুনা সংগ্রহ করা হয়।
  • প্রতি পাঁচ ফুট পর পরবর্তী দেড় ফুট পাইপ মাটির অভ্যন্তরে প্রবেশ করাতে যে পরিমাণ আঘাত করতে হয়, তা সাধারণত বিবেচনায় নেয়া হয় না। এর পরের ১২ ইঞ্চি মাটির ভিতরে পাইপ প্রবেশ করাতে প্রয়োজনীয় আঘাতের সংখ্যাকেই বলা হয় N এর মান।
  • সাধারণত N এর মান ১৫ এর কম হয়ে থাকে। তবে ১৫ এর বেশি হলে মাটি শক্ত বলে বিবেচনা করা হয়। N এর মান অনুসারে মাটির ভার বহন ক্ষমতা অনেকটা এরকম:
Load Capacity According to Soil Report

জমির মালিক হিসাবে সচেতন থাকা উচিৎ যেন জমির মাপ অনুসারে সুষমভাবে সঠিক সংখ্যায় বোরিং হোল করার মাধ্যমে সয়েল টেস্ট এর মান নিয়ন্ত্রণ করা হয়। জমির মাপ অনুসারে বোরিং হোলের সংখ্যা হবে:

No. of Bore Hole According to Land Area

স্বাভাবিকভাবে কিছু বিষয় সয়েল টেস্টার বা সার্ভেয়ার খেয়াল রাখছেন কিনা তাও নিশ্চিত হয়ে নিন।

  • চাপ প্রয়োগকারী হাতুড়ির ওজন ৬৩.৫ কেজি হতে হবে।
  • কমপক্ষে ৩০ ইঞ্চি উচ্চতা থেকে এটিকে আঘাতের সময় নামিয়ে আনতে হবে।
  • প্রতি ৫ ফুট পর পর আলাদা নমুনা সংগ্রহ করতে হবে এবং তাদের আলাদা আলাদা প্যাকেটে সংরক্ষণ করতে হবে।
  • প্রতিটি ক্ষেত্রে N এর মান আলাদাভাবে লিপিবদ্ধ করতে হবে।
  • মাটি ভালো থাকলেও কমপক্ষে ৬০ ফুট পর্যন্ত নমুনা সংগ্রহ করতে হবে।

খরচপাতি

বাড়তি খরচের ভয়ে অনেক জমির মালিকই সয়েল টেস্ট করতে চান না। অথচ মোট নির্মাণ ব্যয়ের তুলনায় সয়েল টেস্টিং এর খরচ প্রায় নগণ্য। ধরে নিন, আপনার ৫ কাঠা জমি রয়েছে ও আপনি FAR বা MGC মেনে যদি একটি ছয় তলা বাড়ি তৈরি করতে চেষ্টা করেন, আপনার নির্মাণ ব্যয় হতে পারে চার থেকে সাড়ে চার কোটি টাকার মতো। অথচ বাংলাদেশে খুব ভালো মানের কোম্পানির মাধ্যমে সয়েল টেস্ট করাতে আপনার খরচ হতে পারে সর্বোচ্চ ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা। এই খরচের কারণেই নিশ্চিত হতে পারে আপনার ভবনের নিরাপদ ভবিষ্যৎ ও সঠিক ফাউন্ডেশনের যাচাই ও বাছাইয়ে প্রকৌশলীর যথাযথ আস্থা।