সৃষ্টিজগতে আমরা চোখের সামনে যা দেখি, সবকিছুর জন্যই একটি সুন্দর ও দৃঢ় কাঠামো অত্যন্ত জরুরি একটি বিষয়। কাঠামো ছাড়া কোনো কিছু দিনের পর দিন দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। মানবদেহের জন্য যেমন আমাদের ২০৬টি অস্থি নিয়ে গঠিত অস্থিকাঠামো রয়েছে, ভবনের জন্যও এধরনের একটি কাঠামো প্রয়োজন হয়। সাধারণত এই কাঠামোগত প্রশ্নের সমাধান করা হয় বীম ও কলাম দ্বারা।

বীম  কলাম কী?

বীম ও কলাম হচ্ছে ভবনের ভারবাহী কাঠামো উপাদান। ভূমির সাথে আনুভূমিক যেসব নির্মাণ কাঠামো ফ্লোর স্ল্যাব ও ভবনে অবস্থান ও বসবাসকারী সব জীবিত ও জড় পদার্থের ভার বহন করে কলাম পর্যন্ত পৌঁছে দেয় তাদের বলা হয় বীম। আর যেসকল ভারবাহী উপাদান ভূমির সাথে লম্বভাবে অবস্থান করে ও বীম থেকে প্রাপ্ত লোড ফাউন্ডেশন হয়ে ভূমিতে প্রবাহিত করে ভবনকে দণ্ডায়মান রাখে, তাদের বলা হয় কলাম।

Beam
Beam

বীম  কলাম সম্পর্কে যা জানা জরুরি

১. বীম ও কলাম ভবনের প্রাথমিক উপাদানের অন্তর্ভূক্ত। এগুলো ছাড়া ভবন নির্মাণ অসম্ভব। স্থপতি ভবনের প্রাথমিক নকশা প্রণয়নের সময়ই বীম ও কলামের অবস্থান নকশায় উল্লেখ করবেন।

২. বীম ও কলামের অবস্থান ভবন নির্মাণের আগে থেকেই ঠিক করে ফেলতে হবে। এক্ষেত্রে অবশ্যই সর্বনিম্ন ব্যাচেলর ডিগ্রিধারী সিভিল ইঞ্জিনিয়ারের মাধ্যমেই এই ডিজাইন সম্পন্ন হতে হবে।

৩. কলামের অবস্থান ভবনের তলা ভেদে পরিবর্তনযোগ্য নয়। তাই কোনোভাবেই একবার তৈরি হয়ে গেলে কলামের অবস্থান পরিবর্তন করা যাবে না।

৪. বীম বা কলাম সাধারণত কংক্রিট ও রডের সমন্বয়ে তৈরি করতে হয়। এক্ষেত্রে কেবল প্রকৌশলীর ড্রয়িং অবলম্বন করলেই চলবে না, সাথে মিক্সচার, ঢালাইয়ের মান নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে কিউরিং এর সময়কালও হতে হবে লাইসেন্সড প্রকৌশলী অনুমোদিত।

ক্ষেত্রবিশেষে এই কলাম ও বীম সম্পুর্ণ স্টিলের তৈরিও হতে পারে। এটি কিছুটা ব্যয়বহুল। তবে সেক্ষেত্রেও স্টিলের মাপ, জোড়ার প্রকৃতি ইত্যাদি দক্ষ ও প্রশিক্ষিত পেশাদারের নিয়ন্ত্রণে থাকাটা অত্যন্ত দরকারি।

৫. অনেক সময় ভবনের প্রকৃতি অনুসারে কলাম চওড়া হতে হতে ছোট দেয়ালের আকার নেয়। এটিকে বলা হয় ভারবাহী দেয়াল বা শিয়ার ওয়াল। এই শিয়ার ওয়াল তৈরির প্রক্রিয়া অনেকটা কলাম তৈরির মতোই। তবে হিসেব কিছুটা আলাদা হয়ে থাকে।

বীম ও কলাম যে শুধু ভবনের ভার রক্ষা করে তা-ই নয়, বরং প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন- ঘুর্ণিঝড়, ভূমিকম্প, টাইফুন এসবের বিরুদ্ধে ভবনের শক্তির উৎসও এই কাঠামোই। সুতরাং ভবন নির্মাণের এই পর্যায়টিতে প্রকৌশলীরা প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি শক্তি তৈরিতে জোর দেন।

এই অতিরিক্ত শক্তি কত গুণ হবে তা হিসেবের সময় Factor of Safety বা নিরাপত্তা অনুপাত দিয়ে নির্ধারিত হয়। যেমন- নিরাপত্তার অনুপাত ২- এই কথাটির অর্থ হলো, আপনার ভবনের জন্য সর্বোচ্চ যা ক্ষমতা প্রয়োজন, তার দ্বিগুণ শক্তি ভবনের কাঠামোতে তৈরি করা হচ্ছে যেন কোনো অপ্রস্তুত অবস্থায় বা কঠিন পরিস্থিতিতেও ভবন টিকে থাকতে পারে।

সবসময় ভবন নির্মাণের আগেই প্রকৌশলীর কাছ থেকে Factor of Safety সম্পর্কে ধারণা নিয়ে নিন। মনে রাখবেন Factor of Safety কমপক্ষে ১.৫ হওয়া অত্যাবশ্যক।

ক্র্যাক বা ফাটল

ভবনের দেয়ালে ফাটল দেখা গেলে তা খুব সহজেই মেরামতযোগ্য। কিন্তু কোনো কারণে মূল কাঠামোতে ফাটল দেখা গেলে তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বীম ও কলাম ভবনের স্থায়িত্ব কতদিন হবে তার জন্য দায়ী। তাই ক্র্যাক বা ফাটল দেখা যাওয়া মাত্রই এটি কোন ধরনের ফাটল তা নির্ণয় করা ও তা নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া উচিৎ।

ফাটল সাধারণভাবে দুই ধরনের হতে পারে।

১. কাঠামোগত ফাটল (Structural Crack)

২. অবকাঠামোগত ফাটল (Infrastructural Crack)

কাঠামোগত ফাটল বলতেই বীম, কলাম, ছাদ ইত্যাদির ফাটলকে বুঝায়। এটি এড়িয়ে চলতে ভবনের নকশার আগে ভবনের ব্যবহার সম্পর্কে স্থপতি ও প্রকৌশলীকে সত্য ও পরিষ্কার ধারণা দিতে হবে। যেমন- বসবাসের জন্য তৈরি ভবনকে ছোট কারখানা বা অফিসের কাজে ভাড়া দিলে ভবনকে অতিরিক্ত ভর বহন করতে হয়। এক্ষেত্রে অনেক সময়েই কাঠামোর ডিজাইন এই ভর বহনে প্রস্তুত থাকে না। এছাড়া রড ও কংক্রিটের কোনো হিসেবও এদিক-ওদিক করা যাবে না।

Crack in the Wall
Crack in the Wall

এছাড়া কিছু নির্মাণজনিত ত্রুটিও মাথায় রাখতে হবে। যেমন-

১. বীম ও কলামের সংযোগস্থলে দরকারের চেয়ে বেশি রড দেওয়া অনেক সময় হিতে-বিপরীত হতে পারে। এ অবস্থায় সংযোগে কংক্রিট প্রবেশ করতে পারে না।

২. মিক্সচারে পানির পরিমাণ বেশি হলে জলকণা ভেতরে জমা হয়ে থাকে। পরে জলীয়বাষ্প আকারে দুর্বল পথ পাওয়া মাত্র সেটি বের হয়ে আসে। এভাবেই ক্র্যাক বা ফাটল হতে পারে।

৩. কোনো ভবনের ঠিক পাশে যদি ভিত্তি তলের নিচ পর্যন্ত বেজমেন্ট নির্মাণের জন্য মাটি কাটা হয়, তাহলে ওই ভবনের ভিত্তি তলের নিচ হতে মাটি সহ পানি চুঁইয়ে চুঁইয়ে বের হয়ে বেজমেন্টের জন্য নির্মিত গর্তের ভিতর চলে আসে। এতে অনেকসময় ডিফারেনশিয়াল সেটেলমেন্টের কারণে বীম/ কলামে অতিরিক্ত মোমেন্ট/ সিয়ারের সৃষ্টি হয় ফলে ভবনে ফাটল দেখা দেয়।

৪. ভবনের আশেপাশে কোনো বড় আকারের গাছপালা থাকলে বা ছোট গাছ অনেক বড় হয়ে উঠলে তার শিকড়ের বৃদ্ধির কারণে মাঠির প্রকৃতির পরিবর্তন হতে পারে। এটিও হতে পারে ফাটলের কারণ।

এসব কারণে মিক্সচারের সাথে ১২০০ PSI অতিরিক্ত ধরে সবসময় কাঠামোগত ডিজাইন করা হয়। আর তা করতে অবশ্যই প্রয়োজন হবে প্রশিক্ষিত ও দক্ষ প্রকৌশলীর সাহায্য। একটি বিষয় জেনে রাখা খুবই দরকারি তা হলো- নতুন ও পুরাতন ভবনের কাঠামো অত্যন্ত দক্ষ ও অভিজ্ঞ প্রকৌশলী ছাড়া এক কথায় করা অসম্ভব। বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতে এই ধরনের পদক্ষেপ চিন্তা করা খুবই বিপজ্জনক।

তাই নতুন ভবন করার সময় সুচিন্তিতভাবে নিতে হবে সব পদক্ষেপ। হতে হবে সংবেদনশীল ও সতর্ক। তাহলেই ভবন আপনাকে নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তা দেবে যুগের পর যুগ।

Structure Ongoing